মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ছেলে শিক্ষার্থীরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এসএসসি ২০২৪ এর ফলাফলে এমন প্রবণতাই দেখা গেছে। কেন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা খারাপ ফল করছে- তা প্রধানমন্ত্রীসহ অনেককেই ভাবতে বাধ্য করেছে।
ছেলেরা পড়ছে কম, বাইরে ঘুরছে বেশি। ঘরে থাকলেও মোবাইল ফোনে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডুবে থাকছে। ফলে পিছিয়ে পড়ছে ছেলেরা। এছাড়া ছাত্রীরা ক্লাসে যেমন মনোযোগী, আবার বাসায় পড়ালেখার ক্ষেত্রেও তাদের তেমন ঘাটতি দেখা যাচ্ছে না। সেই তুলনায় ছাত্রদের মনোযোগ কম। অনেকে মেধাবী, কিন্তু ক্লাসে মনোযোগ না থাকায় পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, ছেলেদের পিছিয়ে থাকার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হলো- ছেলেদের মধ্যে প্রযুক্তি আসক্তি, ক্লাসে অনুপস্থিতি, বাবা-মায়ের অবাধ্য হওয়ার প্রবণতা। ফলে তারা লেখাপড়ায় অমনোযোগী। এদিক থেকে মেয়েরা অনেকটা পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং লেখাপড়ায় বেশ পরিশ্রমী। একই সঙ্গে নারী শিক্ষায় সামাজিক সচেতনতা, বাল্যবিবাহ রোধ ও উপবৃত্তি চালুর মতো সরকারের কার্যকর বেশকিছু পদক্ষেপের কারণে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ও ফলে সফলতা দুটোই বেড়েছে।
আরও পড়ুন: এসএসসি: ৫১ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেউ পাস করেনি
কয়েক বছর ধরেই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, মেয়েদের থেকে ছেলেরা পিছিয়ে। ছাত্রীদের এগিয়ে যাওয়াকে সবাই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে ছাত্ররা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে।
চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, সবদিক দিয়ে এগিয়ে মেয়েরা। মেয়েদের পাসের হার ৮৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। যেখানে ছেলেরা ৮১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রেও এগিয়ে মেয়েরা। ৯৮ হাজার ৭৭৬ জন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত মেয়ের বিপরীতে ছেলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৩ হাজার ৩৫৩ জন।
চলতি বছরের ১২ মে সকালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'ছেলেরা সংখ্যায় কম এবং কেন ফলাফলে তারা মেয়েদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে,এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে।’ এক্ষেত্রে বেশ তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ছেলেদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ খুঁজে বের করতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। পাশের হারে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে। ভালো কথা। কিন্তু আমাদের এ বিষয়ে নজর দিতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে কিশোর গ্যাং, কেন ছেলেমেয়েরা এ পথে যাবে, এটা তো গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের পড়াশোনা করা দরকার, তারা কাজ করতে পারে, বিভিন্ন কাজে যোগ দিতে পারে। কিন্তু এ লাইনে (কিশোর গ্যাং) কেন গেল, সেটা আমাদের বের করতে হবে। সেখান থেকে তাদের বিরত করা, তাদের একটা সুস্থ পরিবেশে নিয়ে আসা, সেটা আমাদের করতে হবে।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রসঙ্গে ইউএনবিকে বলেন, ছাত্রীদের জন্য আমরা অনেক বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি- দীর্ঘদিন ধরে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। তবে সেগুলো এখন ছাত্র ও ছাত্রী সবার জন্য সমানভাবে দেওয়া হচ্ছে। তবে সেক্ষেত্রে যদি সেটা যথাযথভাবে কাজ না করে, আমরা সেগুলো পরির্তন করে ছাত্ররাও যাতে সমানভাবে ছাত্রীদের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমাদের তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেন। ছেলেরা পিছিয়ে পড়ার আর কী কারণ থাকতে পারে আমরা এ বিষয়ে খতিয়ে দেখব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ইউএনবিকে বলেন, ‘ছেলেরা পড়ছে কম, বাইরে ঘুরছে বেশি। পাশাপাশি মোবাইল ফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডুবে থাকছে, ফলে ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে।’
আরও পড়ুন: এসএসসি: এবার পাসের হার বেড়েছে ২.৬৫ শতাংশ
তিনি বলেন, ছেলেদের পিছিয়ে থাকার কারণ তাদের মধ্যে প্রযুক্তি আসক্তি, ক্লাসে অনুপস্থিতি, বাবা-মায়ের অবাধ্যতার প্রবণতা বেশি। ফলে তারা লেখাপড়ায় অমনোযোগী। এদিক থেকে মেয়েরা অনেকটা পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকে ও লেখাপড়ায় পরিশ্রমী।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি কয়েকটি জরিপ দেখেছি, নিজেও পর্যবেক্ষণ করেছি, স্কুলপড়ুয়া ছেলেটার হাতে বাবা-মা মোবাইল তুলে দিচ্ছে। কিন্তু মেয়েটার হাতে দিচ্ছে না। হয়তো অন্য কোনো চিন্তা থেকে দিচ্ছে না। তাতে মেয়েটা পড়াশোনায় মনোযোগ দিচ্ছে। আর ছেলেটা ফেসবুক, গেমিংয়ে সেটা ব্যবহার করছে। এভাবে ছেলেরা পড়ালেখায় ক্রমেই অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। সবকিছুর একটা বয়স ও সময় আছে। একেবারে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া একজন ছাত্রের হাতে যখন স্মার্টফোন দেওয়া হচ্ছে, তখন সে এটার সঠিক ব্যবহার কতটা করবে সে প্রশ্ন থেকে যায়।’
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ছাত্রীদের মধ্যে অনেক সচেতনতা বেড়েছে, দেশের শিক্ষার জগতে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে মনে করি। মেয়েদের কেন পড়তে হবে, সাবলম্বী হতে হবে- তা নিয়ে তো বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে খুব নিবিড়ভাবে কাজ হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সেটার তো একটা বড় প্রভাব রয়েছে। এটাই কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে। এসএসসি, এইচএসসি বলেন, আর উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বলেন, মেয়েরা এগিয়ে আছে, আর ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী ইউএনবিকে বলেন, বর্তমানে ছেলে শিক্ষার্থীরা এখন ব্যাপকহারে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার করছে। এছাড়া তারা গেমিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করছে। এতে পড়ার সময় তো নষ্ট হচ্ছেই। পাশাপাশি পড়ালেখায়ও অমনোযোগী হয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, নারী শিক্ষায় সামাজিক সচেতনতা, বাল্যবিবাহ রোধ ও উপবৃত্তি চালুর মতো সরকারের কার্যকর পদক্ষেপে শিক্ষায় মেয়েদের অংশ নেওয়া ও ফলে সফলতা দুটোই বেড়েছে।
আরও পড়ুন: এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা-২০২৪: বিদেশি কেন্দ্রে পাস ৮৫.৮৮%
রাশেদা কে চৌধুরী আরও বলেন, ‘ছেলেরা এখন অল্প বয়সে হিরোইজম দেখাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। তারা কিশোর গ্যাং গড়ে তুলছে। হিরোইজম দেখাতে অনেক ছেলে বাবা-মাকেও তোয়াক্কা করছে না। মেয়েদের মধ্যে যে মূল্যবোধ নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে, সেটা ছেলেদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে হবে। তাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা বোঝাতে হবে। তাহলে ছেলেরাও সমানতালে শিক্ষায় এগিয়ে যাবে।’
এছাড়াও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছেলেরা প্রযুক্তির ভয়ংকর ছোবলের শিকার। হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, বাসায় ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ট্যাবে সারাক্ষণ মগ্ন থাকে। প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে মগজধোলাই হয়ে যাচ্ছে। এদের মেধা-মননে লেখাপড়ার চেয়ে নানা রকম অপসংস্কৃতি ঢুকে যাচ্ছে। স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে কিশোর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে। ক্লাস ছেড়ে কিশোররা দলবেঁধে ঘুরছে পাড়া-মহল্লায়—এমন চিত্র চোখে পড়ছে সব এলাকায়। অনেকে কম বয়সে জড়িয়ে পড়ছে রাজনীতিতেও। এতে মেধাবী ছাত্ররা পড়ালেখা বিমুখ হয়ে পড়ছে।
শিক্ষকরা আরও জানান, ছাত্রীদের পড়াশোনায় আগ্রহটা বেশি দেখা যায়। তাদের মধ্যে একে-অন্যের চেয়ে কীভাবে ভালো ফলাফল করবে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা বেশি। এজন্য বরাবরই তারা ভালো করছেন।
এছাড়া, মেয়েরা লেখাপড়ায় পরিশ্রমী এবং নারী শিক্ষায় সামাজিক সচেতনতাও বেড়েছে। বাল্যবিবাহ রোধে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ এবং মেয়েদের উপবৃত্তির আওতায় আনায় মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশ নেওয়া বেড়েছে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ ইউএনবিকে বলেন, ছেলেরা পিছিয়ে যাচ্ছে এটা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখছি মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশ নেওয়া ও সফলতা দুটোই এগিয়ে আছে মেয়েরা। তবে সম্প্রতি পাড়া-মহল্লায় দেখা যায়, উঠতি বয়সী ছেলেরা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। যে বয়সে স্কুলে সময় দেবে, এর পরিবর্তে সে তখন ক্লাসের বাইরে। আমি মনে করি অভিভাবকরা দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে ব্যর্থ। অপরদিকে আমাদের সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা ঘরমুখী। পরিবারের চাপের মধ্যে তারা বাসার বাইরে খুব কম সময় যেতে পারে। ফলে তারা বেশি সময় পড়ালেখায় ব্যয় করতে পারছে। যার ফলে ফলাফল ভালো করছে।
আরও পড়ুন: এসএসসিতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব সাফল্য, কারিগরির চিত্র উল্টো